কাষ্ঠল চিরহরিৎ একটি উদ্ভিদ 'বাঁশ'। ঘরবাড়ি তৈরি, আসবাবপত্র তৈরি ইত্যাদি কাজে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে পাহাড়ি অঞ্চলে কিন্তু এই বাঁশই খাওয়া হয়। এই বর্ষা মৌসুমে পার্বত্য বান্দরবানের বাজারগুলোতে পাহাড়ি সবজি বিক্রেতাদের বিভিন্ন সবজির মধ্যে প্রধান সবজি হিসেবে বিক্রি করছেন 'বাঁশ কোড়ল'।
মূলত বাঁশ গাছের গোড়ার কচি অংশকে বাঁশ কোড়ল বলে পরিচিত সবার কাছে, যা মূলত পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের সবজির তালিকায় পছন্দের একটি সবজি হিসেবে খাওয়া হয়।
বাশঁ কোড়ল পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী নানা সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে একেক নামে পরিচিত, মারমাদের কাছে ‘মহ্ই’ আবার চাকমাদের কাছে ‘বাচ্ছুরি’, আর ত্রিপুরাদের কাছে ‘মেওয়া’ নামে ডাকা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ করে বর্ষাকালে এই সবজিটি বাজারে বেশি পরিমাণে দেখা যায়।
পার্বত্য বান্দরবান জেলাসহ তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ীজন-গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের অন্যতম জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবার ‘বাঁশ কোড়ল’। পাহাড়ের গহিনে প্রায় সব স্থানেই মেলে এ সবজি। বর্তমানে পাহাড়ী জন-গোষ্ঠিদের পাশাপাশি অনেক বাঙ্গালিদেরও জনপ্রিয় একটি খাবারে পরিণত হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে জেলার পাহাড়ি এলাকার গহিনে প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেওয়া বাঁশ ও ব্যক্তিগত বাগানে বাঁশ জন্ম নেয়। এসব বাঁশ পরিণত হওয়ার আগেই স্থানীয় পাহাড়িরা বাঁশ গাছের গোড়ার কচি অংশ সংগ্রহ করে তা প্রতিদিন স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসে।
জানা গেছে, বছরের মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ সবজির ভরা মৌসুম থাকে। মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, কালিছুরি বাঁশসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায় স্থানীয় বাজার গুলোতে। প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র কিছু মানুষ এই বাঁশ করুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন সকাল বিকেল জেলা ও উপজেলা শহরের মগ বাজার, বালাঘাটা বাজার, কালাঘাটা বাজারসহ বিভিন্ন স্থানীয় হাটবাজারে বাঁশ কোড়ল নিয়ে যান স্থানীয় পাহাড়ীরা।
বাঁশ কোড়ল বিক্রেতা চিংম্রা সাং মার্মা(৪৭) তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাঁশ কোড়ল আহরণ করে বিকালে বাজারে বিক্রি করতে আসেন কখনো ৪শত কখনো ৫-৬শত টাকার বাঁশ কোড়ল বিক্রি করেন সেই টাকা দিয়ে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে নিয়ে যান। প্রতিবছর মে মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৬ জনের পরিবার বাঁশ কোড়ল বিক্রির আয়ের টাকায় পরিবার চলে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় উপায়ে রান্না করা বাঁশ কোড়ল খেতে যেমন সুস্বাদু তেমন শরীরের জন্যও উপকারী।
দৈহিক সুস্থতায় বাঁশ বেশ উপকারী। বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি মেলাতে এর কার্যকারিতা অপরিসীম। আর তাইতো এই বাঁশের কোড়লকে চীনারা বলে থাকেন ‘স্বাস্থ্যকর খাবারের রাজা’।
জেনে নেওয়া যাক বাঁশের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে-
তাজা বাঁশের কোড়লে যা যা রয়েছে-
পানি- ৮৮ থেকে ৯৩ শতাংশ, প্রোটিন- ১.৫ থেকে ৪ শতাংশ, চর্বি- ০.২৫ শতাংশ থেকে ০.৯৫ শতাংশ, চিনি- ০.৭৮ থেকে ৫.৮৬ শতাংশ, সেলুলোজ- ০.৬০ থেকে ১.৩৪ শতাংশ, খনিজ পদার্থ- ১.১ শতাংশ
এছাড়াও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন।
বাঁশ কোড়লের যত উপকারিতা-
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
বাঁশের কোড়লে রয়েছে উপকারী সব উপাদান যা দেহের কোলেস্টরেলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
রক্তচাপ রাখে নিয়ন্ত্রণে
দেহের রক্তচাপের মাত্রা কমায় এটি। যারা উচ্চ রক্তচাপ সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য উপকারী একটি খাবার হলো বাঁশ কোড়ল। এটি ক্যানসারের ঝুঁকিও কমায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
হজমজনিত সমস্যা কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় ভুগছেন? খাবার তালিকায় রাখুন বাঁশ। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে দারুণ কার্যকর।
নানা রোগের নিরাময়
হাঁপানি, ডায়াবেটিস, তীব্র জ্বর, মূর্ছা যাওয়া, মৃগী রোগ ইত্যাদি নিরাময়ে যথেষ্ট উপকার করে বাঁশ।
বাজারে পাওয়া যায় এমন সবজিগুলোর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় বাঁশের কোড়ল। বরং, এর উপকারিতা অনেক। তাই নিয়মিত বাঁশ খেতে পারেন নিশ্চিন্তে।
উল্লেখ্য, সদ্য অঙ্কুরিত কচি বাঁশকে বলা হয় বাঁশ কোড়ল। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলোতে এটি খাওয়া হয় বেশি। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের মেঘালয়, আসাম, হিমালয় অঞ্চলে, নেপাল, ভুটান, কোরিয়া, চিন, জাপানেও বেশ জনপ্রিয় এই বাঁশ কোড়ল।