গল্প আমি কখনোই লিখিনা, পারিওনা লিখতে। গল্পটা কেমন যেন নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে। আমার আনাড়ি হাতে তাকে আমি তেমন একটা ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। দেবনা ভেবেও গল্পটা না দিয়ে পারলাম না; হয়তোবা কারো ভাল লাগতেও পারে।
একটি আষাঢ়ে ভালবাসার গল্প
গল্পের মেয়রা অসম্ভব রূপবতী হয়। দুধে আলতা গায়ের রঙ্গে, নীলবসনা, হাতে এক গুচ্ছ চুড়ি, আর মাথায় গুঁজে দেওয়া আগুন রাঙ্গা কৃষ্ণচূড়া ফুলে যেন স্বর্গের নীল অপ্সরী মনে হয়। রংধনুর সাত রঙের মতই রঙ্গিন হয় তার জীবন, চঞ্চল আর মুখর হয় তার পদচারনা। তাকে কখনো কাঁদতে হয় না, হাঁসিতে যেন মুক্তো ঝরে। কোন এক রাজপুত্র এসে কোন এক প্রহরে তার হাত ধরে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি, শরতের সাদা মেঘ, সন্ধ্যায় মিটিমিটি জ্বলা জোনাকি, মাঝ রাতের নীল জোছনা, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, দূর আকাশে উড়ে বেড়ানো দুরন্ত চিল, দীঘিতে সদ্য ফুটন্ত নীল পদ্ম, ঝোপে ঝাড়ে উড়ে বেড়ানো রঙ্গিন প্রজাপতি এই সবই এনে দিতে পারে তার একটু হাসির জন্য। গল্পের শেষ টায় পঙ্খিরাজে করে তারা রাজপ্রাসাদে চলে যায়। এইত ভালবাসার গল্প।
আমার গল্পের মেয়েটার নাম ছিল রূপকথা। কোন এক আষাঢ়ের রাতে আষাঢ়ের মেঘের মতই কালো মেয়েটার জন্ম। রূপের বালাই নেই যেন একটুও, এ যেন কোন এক লক্ষ্মীছাড়া সৃষ্টি। অসম্ভব শান্ত আর চুপচাপ ছিল মেয়েটি, কথার ফুলঝুরি কখনোই ছিলনা তার, নিশাচর প্রাণীর মতই নিশব্দ ছিল তার পদচারনা। রূপকথার রূপ আর কথা কোনটাই যেন নেই তার। এ যেন নামকরণের অনেক বড় আসার্থকতা। কিন্তু কোন এক জাদুবলে অসম্ভব মায়া ছিল তার মধ্যে। সবাইকে মায়ার জালে জড়িয়ে নিতে পারত, সহজেই ভালবাসতে পারত। ঘাসফড়িং আর ছোট লাল পিপড়ার জন্যও সে কান্নায় বুক ভাসাত। প্রকৃতি রূপ না দিলেও অসম্ভব ভালবাসা দিয়েছে তার মধ্যে।
আর হ্যাঁ, এটা কোন প্রাচীন রাজকাহিনী নয়। দুরন্ত গতিতে ছুতে চলা নতুন যুগের একটি ছোট গল্প।
মা বাবা আর বড় ভাই বোনের অতি আদরের ছিল রূপকথা। বাড়ির সবার ছোট হয়েও চঞ্চলতার বালাই ছিল না তার মধ্যে। বাড়ির ছোট্ট সাদার ভিতরে কাল ছোপ দেওয়া বেড়াল ছানাটা ছিল তার খেলার সাথি। সারাদিন তার পিছনে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বেড়ানো ছিল তার কাজ। একটু বড় হলে সে প্রজাপতি দেখতে দেখতে ঘুরে বেড়ায়। প্রজাপতির বর্ণছটায় মুগ্ধ হয়ে সে রঙ্গিন ছবি আঁকা শুরু করে। তার হাতের ছোঁয়ায় কাগজের মধ্যে গাছ-পালা, নদী, সূর্য, রংধনু, ঘাসফড়িং সবকিছুই যেন জীবন পায়। পুকুর পাড়ে ঝোপের পাশে বসে সে রংধনুর কথা ভাবে। শীতের সকালে ঘাসের ওপর পরা শিশির বিন্দু গুলো সে আলতো হাতে স্পর্শ করে। রংধনু, পুকুর আর বেড়ালছানা ছাড়া তার তেমন কোন বন্ধু কখনো হয় নি। ছোট থেকেই আত্মীয় স্বজন আর পরিচিতজন সবাই কালো বলায় সে নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতে থাকে আর খুব সংকুচিত হতে থাকে। এভাবেই বড় হয় রূপকথা একটু একটু করে।
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় পেড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করে রূপকথা। শান্ত আর ভীত সন্ত্রস্ত রূপকথা ছোট শহরের গণ্ডি পেড়িয়ে বড় শহরে পা দেয়। তার চেনা জগত, তার মা বাবা ভাই বোন, তার বাড়িঘর, গাছপালা, পুকুরঘাট, তার বেড়ালছানা ছেড়ে এই অচেনা অজানা জায়গায় এখন জানেনা সে কিভাবে থাকবে। নতুন জায়গায় হাজারো নতুন মানুষের ভীরে বড্ড সংকুচিত হয়ে থাকে। রাতে চুপচাপ জানালার পাশে বসে আকাশের তারা গুলো দেখে সে। হাজারো নতুন, অজানা, অচেনার মাঝে এটাই শুধু চেনা তার। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, গলা ভিজে আসে। এরপর দুচোখের পাতায় নামে বাধভাঙ্গা অশ্রু। একসময় দুচোখের পাতা ভার হয়ে ঘুম নেমে আসে। ভেজা দুই চোখে অপার্থিব মায়া নিয়ে ঘুমিয়ে পরে।
পরের দিন ঘুম ভাঙ্গা চোখে নতুন জায়গা চিনে নিতে একটু সময় লাগে রূপকথার। সকালেই ক্লাসে যায় সে। নতুন আর অপরিচিত মুখগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। না, কেও তাকে খেয়াল করেনি। জানালার পাশে এক ফাকা জায়গা পেয়ে সে বসে পরে। মনে মনে ভবে এখানে সবাই নতুন এসেছে আজ তার মতই। সবার মধ্যেই একটু চঞ্চলতা ভাব, সবাই সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে কারণ পরবর্তী কয়েক বছর এদের সাথেই থাকতে হবে। এক কোণে বসে চিন্তিত রূপকথা ভাবতে থাকে সে কি করবে। তখন চুপচাপ সে তার ছবি আঁকার ডাইরিটা খুলে জানালার পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। না, কেও তাকে কিছু বলতে আসে না, তার নাম জানতে আসে না। তাতে কিছু সমস্যা নেই, বরং চুপচাপ নিজের মত থাকতেই সে ভালবাসে। চারিদিকের কোলাহলের মাঝে এ যেন এক বিন্দু নীরবতা।
এরপর এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, সন্ধ্যা নামে, রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসে, আর একইভাবে দিন পার হয়। আর এমন করেই রূপকথা আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে থাকে। এরই মধ্যে সে তার পাশে বসা একটি মেয়ের সাথে কথা বলে কিছুটা সহজ হয়ে নেয়। মাঝে মাঝে আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। আবার সে প্রজাপতির ছবি আঁকে। পাশেই এক পদ্মদীঘি দেখে সে ভালবেসে ফেলে তাকে। তার পাড়ে বসে সূর্যাস্তের ছবি আঁকে রূপকথা। থই থই পানিতে ভাসতে থাকা পদ্ম তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রায়ই সে দীঘির পাড়ে বসে জলের সৌন্দর্য দেখে।
ক্লাসের সবচেয়ে চঞ্চল আর দুরন্ত ছেলেটি হচ্ছে রৌদ্র। প্রখর রোদের মতই তার তেজ আর দস্যিপনা। তার দৌড়াত্বে সবাই অস্থির। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কারণেই মুখরিত হয়ে থাকে ক্লাসের সবাই। সুদর্শন আর মুখর ছেলেটি পড়ালেখায়ও খুব তেজস্বী। রৌদ্রর দুরন্তপনায় প্রায়ই তাকে খেয়াল করে রূপকথা।
সবসময়ই একই জানালার পাশে বসা আনমনা মেয়েটিকে রৌদ্র প্রায়ই দীঘির পাড়ে বসে থাকতে দেখে। নেহায়েত কৌতূহলে একদিন মৃদু পায়ে পাশে গিয়ে দাড়ায়। দেখে সে নিমগ্ন চিত্তে একটি নীল মাছরাঙ্গা দেখছে আর একটু একটু হাসছে। হঠাত রূপকথা সংবৃত ফিরে পায় আর পেছনের ছেলেটিকে দেখে অসম্ভব ঘাবড়ে গিয়ে আচমকা ছুটে পালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় রৌদ্র মূর্তির মত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখনই সে দেখতে পায় যাওয়ার পথে মেয়েটি একটি ডাইরি ফেলে গেছে। রৌদ্র সেটা হাতে নিয়ে দেখতে পায় তার উপরে নাম আছে রূপ ও কথা। কিছুটা সঙ্কোচ নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধা দন্দে ভুগে এর পর সে ডাইরির পাতাগুলো উল্টাতে থাকে। সেখানে সে অনেক সুন্দর ছবি দেখতে পায়। একসময় তার নিজের একটি আঁকা ছবি দেখে সবচেয়ে অবাক হয়। কোন অলক্ষে যেন কোন এক ক্লাসের ফাঁকে মেয়েটি তার ছবিটি এঁকেছে।
নিজের ঘরে গিয়ে সে নিজের আচরণেই অবাক হয়ে যায় রূপকথা। ওভাবে ছুটে আসার কারণ সে বুঝতে পারেনা। লাজুক আর আনমনা হলেও সে পাগল তো না যে পাগলের মত কাণ্ড করবে। সে তার ডাইরিটা তখন আর খুঁজে পায় না। খুঁজে খুঁজে সে দীঘির পাড়ে যায় কিন্তু সেখানেও ডাইরি পায় না। এর পর ঘরে এসে মন ভার করে বসে থেকে সে ঘুমিয়ে পরে।
পরদিন ক্লাসে এসে রৌদ্র জানালার পাশের ওই জায়গায় গিয়ে বসে। একটু পরে রূপকথা এসে রৌদ্রকে বসে থাকতে দেখে কি করবে বুঝতে পারেনা। রৌদ্রই তার ডাইরিটা এগিয়ে দেয়। সেই সাথে তার বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। রূপকথা তার জড়তা খানিকটা কাটিয়ে প্রথমবার কারও সাথে সত্যিকারের বন্ধুত্ব করে।
সেদিন থেকে তার একাকীত্ব অনেকটাই ঘুচে যায়। গোমড়া মেয়েটা হাসতে পারে। রৌদ্র তাকে চারিদিক দেখায়, সবকিছু চিনিয়ে দেয়। বাইরের জগতে নিয়ে যায় রূপকথাকে। রূপকথার জীবনে পরিবর্তন আসে। সে গল্প করতে পারে, ছুটে বেড়াতে পারে, আর যেন কিছুতেই কোন সঙ্কোচ নেই তার। এর পর বছর ঘুরে যায়, রূপকথা যেন নতুন রূপকথা। রৌদ্র তাকে কখনো আলাদা হতে দেয় না। রূপকথা রৌদ্রর মধ্যে অন্য এক পৃথিবী দেখতে পায়।
এর পর কোন এক শ্রাবণের বৃষ্টিতে রূপকথা এক কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছিল আর ভিজছিল। হটাত রৌদ্র এসে তার হাতটা আলতো করে স্পর্শ করে। চমকে উঠে রূপকথা তার চোখের দিকে তাকায়। রূপকথার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সেটা বৃষ্টির জলের সাথে মিশে যায়। রূপকথা কেন যেন কথা বলতে পারেনা আর দৌরে চলে যায়। নিজের ঘরে গিয়ে রূপকথার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়। সেদিন আবার শ্রাবণের ঢল নামে তার দুচোখ বেয়ে। বুকের মধ্যে থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চায়। আজ যে সে বুঝতে পারে, সে তো ভালবাসে। পাগলের মত কাঁদতে থাকে সে। সে কেন ভালবাসে। তার জন্য তো ভালবাসা নেই। সে কাউকেই বলতে পারেনা। কিছুই ভাবতে পারেনা সে। সে যদি আজ বলে তাহলে হয়ত তার সামনে পাহাড় দাঁড়িয়ে যাবে, সকল দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। সে হয়ত একদমই নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। কি করবে সে।
পরদিন সে চুপচাপ বসে ভাবে। কিছুতেই সে নিজেকে বোঝাতে পারে না। তার সারা পৃথিবী অন্যরকম মনে হয়। সেদিনও বৃষ্টি ছিল। সে ভাবে আর ভাবে। একসময় উঠে যায় সে। তার প্রিয় নীল শাড়িটি পড়ে সে। ছুটে যায় কৃষ্ণচূড়া গাছের কয়েকটা ফুল কুরিয়ে আনে। প্রকম্পিত হৃদয়ে সেদিন বিকেলে ভিজতে ভিজতে রৌদ্রের সামনে দাড়ায়। অনেক সাহস নিয়ে সে রৌদ্রকে বলে,- ভালবাসি তোমায় অনেক বেশি। সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালবাসি। আজ ভালবাসি, কালও বাসব। নেবে কি তুমি আমায়? বল নেবে কি? – রৌদ্র কিছুক্ষণ চুপ থাকে। এর পর খানিকটা বিদ্রূপের স্বরে বলে যে- তা হয়না। আমি তেমন ভাবি না। আমি কখনোই তেমন চাই নাই। আমি যাকে ভালবাসব সে তো জগত আলো করা সৌন্দর্য নিয়ে আসবে।
না না, রৌদ্র তার জায়গায় ঠিক ছিল। পাগল বোকা মেয়েটা বোঝেও বোঝেনি যে, ভালবাসতে নাই তার। তখন রূপকথা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অশ্রুসিক্ত অবনত নয়নে সে আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসে।
এর পর? তার আর পর কি থাকে? তাও বলি- সেদিন সন্ধ্যায় রূপকথাকে আর কোথাও খুজে পায়না কেও। পরদিন ভোরে পাওয়া যায় রূপকথাকে; তার প্রিয় পদ্মদীঘির জলে, তার ভালবাসার নীলপদ্মগুলোয় জড়ানো। নিথর, নিস্তব্ধ, নির্জিব।
- Barnali Chaity